মঙ্গলবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১২

আমার স্কুল জীবন ১৯৪৪-৪৯

আমার কৈশোর


উপরের ছবিটা মনে হয় ১৯৩৮ সাল নাগাদ তোলা হয়েছিল। কাজেই ছবিটা "আমার ছোটবেলা" পেখাতে দেওয়া উচিত ছিল।

১৯৪৪ সাল পরতেই আমাদের আবার স্কুল ভর্তি হবার চিন্তা সুরু হল। ইতিমধ্যে আমরা বাড়িতে পড়াশুনা করে নেওয়াতে আমাদের মেট্রপলিটান ইন্সটিটিউশন (মেন) স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি করে নিল। শঙ্কর ঘোষ লেনের উপর স্কুলটা। আমাদের বাড়ি থেকে হেটে বোধ হয় পাঁচ মিনিট সময় নিত। এই স্কুলের স্মৃতি আমার কাছে এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে। স্কুলের হেড মাস্টার ছিলেন ধরণী বাবু আর সুপারিন্টেন্ডেন্ট ছিলেন তুলসী বাবু। আমার প্রিয় মাস্টার মশাই ছিলেন বাংলার অনিল বাবু, ইতিহাসের পুলিন বাবু, আর বিজ্ঞানের অনিল বাবু। বিজ্ঞানের অনিল বাবু আবার আমাদের স্পোর্টসের টীচারও ছিলেন। বাংলার অনিল বাবু ছিলেন প্রায় সোয়া ছ ফিটের মত লম্বা আর তাঁর গলা বেশ লম্বা ছিল বলে তাঁকে আড়ালে 'বক' বলা হত। এছাড়া সংস্কৃত পড়াতেন আচার্য্য মাস্টার মশাই যাকে আমরা 'পাউরুটি' বলে আড়ালে ডাকতাম। এখানে বলে রাখা ভাল আমি আর দাদার মধ্যে বয়সের পার্থক্য মাত্র দেড় বছরের ছিল বলে আমরা দুজনে এক ক্লাসে পড়েছি, একসাথে খেলেছি, আমাদের বন্ধুরাও দুজঙ্কে একসাথে দেখতেই অভ্যস্ত ছিল।

স্কুলের সহপাঠীদের প্রায় সবার নামই ভুলে গেছি কিন্তু মনোরঞ্জনের নামে মনে আছে কেননা সে ছিল আমার সব চেয়ে প্রিয় বন্ধু। ক্লাসে আমরা তিনজন দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলাম কাজেই দিলীপ ১,দিলীপ২, আর দিলীপ ৩ বলে আমাদের রোলকল হত। এবার মনোরঞ্জনের কথায় আসি। কলকাতার বিখ্যাত 'যমুনালয়' কাপড়ের দোকানের মালিক ছিলেন ওর বাবা। মানিকতলা বাজারে আর আমাদের বাড়ীর উল্টোদিকে শ্রীমাণী বাজারের পাশে ওঁদের দুটো দোকান ছিল। থাকত মানিকতলা বাজারের উপরে। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় ঠিক মনে নেই কি কারণে আমি ওর উপর প্রচন্ড রেগে গিয়ে জিওমেট্রি বক্সের থেকে ডিভাইডার নিয়ে তাড়া করে ওর হাটুতে ফুটিয়ে দিয়েছিলাম। বেচারা তার জন্য প্রায় দু মাস স্কুলে আসতে পাড়েনি। যদি এ লেখা ওর বা ওর ছেলেমেয়েদের কারুর চোখে পড়ে তবে এটা যেন জানে যে আমি আমার ওই কাজের জন্য অনুতপ্ত। কিন্তু পরে ও যখন স্কুলে এল তখন থেকে আমাদের বন্ধুত্ব অত্যন্ত গভীর হয়ে উঠেছিল।


মনোরঞ্জনকে ক্লাসে কাননবালা বলে ডাকা হত। এটা নয় যে ওকে দেখতে বা ওর গলার আওয়াজ মেয়েদের মতন ছিল। সেই সময় "শেষ উত্তর" নামে একটা সিনেমা খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। নায়ক ছিল প্রমথেশ বড়ুয়া আর নায়িকা ছিল কাননবালা। নায়কের সিনেমার নাম ছিল মনোজ। আমাদের ছোটদের লজিক অনুযায়ী মনোজ = মনোরাঞ্জন = কাননবালা। ও কিন্তু ওর এই অদ্ভুত নামে কোনদিন রাগ করেনি। বাড়ীতে ওর মা ছিলেন। বহুদিন আমি ওঁদের বাড়ীতে সকালে গিয়ে সন্ধে বেলায় বাড়ী ফিরেছি।


৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ হবার পরে কলকাতার বাজারে আর্মি ডিস্পোজালের জিনিষ পাওয়া যেতে লাগল। এগুলোর মধ্যে এগ পাউডার, ক্র্যাফট মিল্ক আর হার্সেস চকোলেট আমরা খুব ব্যবহার করেছি। এগ পাউডার জলে গুললেই অমলেটের জন্যে ডিমগোলা হয়ে যেত,আর খুব সহজেই অমলেট তৈরী করা যেত। ক্র্যাফট মিল্ক ছিল আজকের হর্লিক্সের মত। আর এখনকার ক্যাডবেরী বারের মতন হার্সেস চকলেটের বার দু আনাতে পাওয়া যেত। আমরা খুব খেয়েছি। এছাড়া ছিল স্মোক বম্ব। একটা ২৫০ গ্রামের ঘিয়ের শিশির সাইজের কৌটো, তাতে একটা ছোট নজল আছে, সেটা খুললেই ধোঁয়াতে ঘর ভরে যেত, আর ঘরের যত মশা হয় মরত নয় পালাত। এ ছাড়া মানিকতলা বাজারের পাশে ব্যবহার হয়ে যাওয়া বুলেট ঢেলে বিক্রির জন্য পরে থাকত। এমন নয় যে সমস্ত বুলেটগুলো আর ব্যবহার্য নয়। কিছু বুলেটের পেছন থেকে সীসে গলে বেরিয়ে থাকত আর লম্বায় একটি ছোট হত, মানে ওগুলোর পেছনের বারুদের অংশটা নাই। আর অনেক বুলেটের পুরোটাই পাওয়া যেত। আজকে হলে ওইগুলো নিশ্চয়ই আতঙ্কবাদীদের হাতে চলে যেত, কিন্তু আমরা ওই বুলেটে কারবারীদের কাছ থেকে খেলবার জন্য চেয়ে নিয়ে এসেছি।


এই রকম সময়ে বড় পিসেমশাই, দ্বিজেন চ্যাটার্জী, ডুয়ার্সে চা বাগানে বড় বাবু হিসাবে কাজ করতেন। তার দুই ছেলেও ওই চা বাগানে কাজ করতেন। বড় ধীরেন, যার কথা আমি আগেই লিখেছি, আর ছোট বীরেন। এই বীরেনদা কলকাতায় এলেন বাগানের ক্লাবের কিছু জিনিষ কিনতে (প্রধাণত অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সাহেবদের জন্য মদ )
দেখা গেল যে মালের ওজন এত বেশী যে তার জন্য বেশ কিছু যাত্রী টিকিট কিনতে হবে। ছোড়দা বাবাকে প্রোপোসাল দিল যে আমরা ওই টিকিটে তার সাথে চা বাগানে ঘুরে আসি। অতএব এক সন্ধ্যায় আমরা শেয়ালদহের থেকে ট্রেনে করে রওয়ানা হলাম। মাঝ রাতে পার্বতীপুরে গাড়ী বদল করে মিটার গেজের গাড়ীতে উঠে পরের দিন দুপুরে আমরা কালচিনি স্টেশনে পৌঁছলাম। সেখন থেকে বাগানের গাড়ীতে চড়ে চুয়াপাড়া চা বাগানে পৌছতে প্রায় বিকেল। এই প্রথম চা বাগানে গিয়েছি। বড়বাবুর কোয়ার্টার অন্য বাড়ীগুলোর চেয়ে বড়।কাঠের মেঝে টিনের ছাদ, কাঠের খুঠির উপর জমির থেকে কম করে ৭/৮ ফিট উপরে মেঝে। রান্নাঘর স্নানের জায়গা, টয়লেট সিড়ি দিয়ে নীচে নেমে করতে যেতে হবে। ছোড়দার তিন ছেলে আর এক মেয়ে। মেয়ে ইন্দিরা, ছেলেরা কানু, শঙ্কর আর রামু। এর মধ্যে শঙ্কর আমার সমবয়সী, হয়তো দু একমাসের ছোট বড় হবে। কাজেই আমাদের দুজনের মধ্যে খুব সহজেই মিল হয়ে গেল। সম্পর্কে আমি কাকা কিন্তু সমবয়সী হওয়াতে সেটার প্রয়োগ হত না।

চা বাগানের পাশদিয়ে কালজানি নদী বয়ে গেছে। ভুটান থেকে বেড়িয়ে এসেছে। বর্ষার সময় ছাড়া নদীতে জল থাকে না, কিন্তু পাহাড়ে বৃষ্টি হলে নদীতে বান আসে আর সামনে যা পায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। একদিন আমরা সেই কালজানি নদিতে গিয়ে নদির ভেতরে অনেক দূর পর্যন্ত চলে যাওয়ার পর হঠাত দূরে গুড়গুড় আওয়াজ শুনে কন্রকমে নদির পারে দৌড়ে এসছি আর হুড়হুড় করে সারা নদী ভরে জলের বান। স্রতের টানে বড়বড় গাছ ভেসে যাচ্ছে দেখলাম। বাড়ী ফেরের পরে আমাকে আর শঙ্করকে পিসেমশাইর কাছ থেকে বকুনি খেতে হয়েছিল। সময়টা ছিল চা পাতা তোলার। বাড়ীর সামনেই ছিল চা তৈরীর কারখানা। সব সময়ে চায়ের সুন্দর গন্ধ ভেসে আসত।


এর মধ্যে একবার কি করে চা তৈরী হয় তা দেখবার সুযোগ হল। চা গাছের ওপর দিক থেকে কচি পাতা তুলে প্রথমে ওজন করা হত। তার পর সেই পাতা গুলোকে লম্বা ট্রে তে বিছিয়ে দেওয়া হত। কদিন বাদে তাদের তুলে তাদের প্রেসে দিয়ে রস বার করে রসটা ফেলে দেওয়া হত। ছিবড়েটা এবের চলে যেত ভাজা হতে, শুকনো হাওয়াতে উপর থেকে ছিবড়েগুলোকে ঢালা হত আর নীচের দিক থেকে গরম হাওয়া দিয়ে শুকনো করে ভাজা হত। ঠিক এই ভাবেই পাতার আকার ভাগ করে 'অরেঞ্জ পিকো, পিকো, ব্রোকেন অরেঞ্জ পিকো, ফ্যানিংস, ডাস্ট আলাদা করা হত। আজকে যে সিটিসি চা পাওয়া যায় তার তখন প্রচলন ছিল না। ডুয়ার্সের চা তে কড়া ভাব আর গন্ধ দুইই থাকাতে এর ডিমান্ড ছিল। আসাম চা তার কড়া ভাবের জন্য আর দার্জিলিং চা তার গন্ধের জন্য বিখ্যাত। দিন পনের থাকার পরে আমরা আবার কলকাতায় ফিরে এলাম।


'৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ হবার পরে আস্তে আস্তে কলকাতায় সাধারণ জীবনধারায় ফিরতে শুরু হল। আমাদের স্কুল, তার পড়াশুনা আর বিকেলের খেলা পুরোদমে চলতে লাগলো। সেই সময় আমাদের খেলা ছিল সাধারণত সাত খোলাম বা পিট্টু, যেটাকে seven tiles নামেও জানা যেত, আর নয়ত রাস্তাতে টেনিস বল (ক্যাম্বিস বল) নিয়ে ফাইভ সাইড দল গরে পাড়ায় পাড়ায় টুর্ণামেন্ট খেলা। কলকাতার বাদুরবাগান এরিয়াতে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের পেছনে বঙ্গীয় ব্যায়াম সমিতিতে লাঠিখেলা শেখা। বিকেলে সাড়ে চারটের পরে খেলতে যাওয়া আর ঝড় জল বৃষ্টি ভূমিকম্প যাই হোক না কেন ঘড়ীতে সাতটা বাজার মধ্যে বাড়ীতে ঢুক্তে হত, নয়ত বাবার কাছে মার খেতে হত। তাই জোর খেলা চললেও, আমাদের নজর থাকত রাস্তার ধারে কোন বাড়ির জানলা দিয়ে দেখা ঘড়ীর উপর। আমাদের টেনিস বলের টীমের নাম ছিল পঞ্চপাণ্ডব। রেগুলার খেলোয়াড় ছিলাম আমি, দাদা, মাস্তুতুত ভাই (দাদামণি), সহপাঠী সুন্দরীমোহন আচার্য্য, দাদামণির ছোট ভাই নিরু আর জেঠতুত দাদা (মেজদা বা ধ্রুব)
আমি সাধারনত ফরয়ার্ড হিসাবে খেলতাম, নয়ত গোলকিপার।

'৪৬ সালের আগষ্ট মাসে আমাদের টীমের খেলা ছিল নক আউটে গড়পাড়ের তেলকল মাঠে। তারিখটা ছিল ১৬ই
 আমাদের বাড়ী থেকেই ১৬ তারিখে বাইরে খেলতে যাবার বারণ ছিল। সকালে স্কুল যাবার আগেই রাস্তাতে লোকেরা এক এক জায়গাতে জড় হয়ে নিজেদের মধ্যে কি সব আলোচনা করতে লেগেছিল, আমাদের স্কুলেও যাওয়া বারন হয়ে গেল। দুপুরের মধ্যে রাস্তার লোকেদের কাছে শুনতে পাওয়া গেল কলকাতায় হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে মারামারি (দাঙ্গা) শুরু হয়ে গেছে। কলকাতা তখন নানান ধর্মালম্বীদের জন্য নানান পকেট এরিয়াতে ভাগ ছিল। ঊত্তর কলকাতা হিন্দুপ্রধান, কলেজ স্ট্রীট-কলুটোলা-মেছুয়াবাজার ধরে চীতপুর থেকে পুর্ব দিকে শেয়ালদহ পেরিয়ে বেলেঘাটা এলাকা মুসলিমপ্রধান। মধ্য কলকাতা, (ধর্মতলা,চৌরঙ্গী, পার্ক স্ট্রীট) অফিস এলাকা এবং খৃষ্টানধর্মালম্বী। আবার বেলেঘাটা থেকে কলকাতার পুর্ব দিক ধরে বন্ডেল রোড পর্য্যন্ত মুসলিমপ্রধান, দক্ষিণ কলকাতা হিন্দুপ্রধান আর খিদিরপুর ওয়াটগঞ্জ এলাকা মুসলিমপ্রধান। আজকের দিনে এটা ভাবা প্রায় অসম্ভব যে এরকম ধর্মীয় ব্লকে লোক থাকতে পারে কেননা আজকে কলকাতা অনেক কসমোপলিটান হয়ে গেছে। আমি এই দাঙ্গার বিশদ বিবরণ দেবনা কারণ আজকে দেখছি লোকে ধর্মের নামে এত বেশী সহনশীলতার অভাব দেখাচ্ছে যে কোন কিছুতে নিজের মত প্রকাশ করবার আগে ভাবতে হয় যে লোকে কি ভাববে। এটুকু লিখলেই যথেষ্ট হবে যে কলকাতাতে সেনাদের নামাতে হয়েছিল এই দাঙ্গা থামানর জন্য। '৪৭এর শেষ পর্য্যন্ত এক ধর্মের লোকেরা অন্য ধর্মালম্বীদের ভাগে যেতে সাহস পেত না।

"৪৬এর দাঙ্গাতে কলকাতার চেহারাটা অনেক বদলে গেল। প্রথমত ভারতবর্ষ ভেঙ্গে ভারত আর পাকিস্তাম তৈরী হল। পাকিস্তান থেকে হিন্দুরা ভারতে আর ভারত থেকে মুসলিমরা পাকিস্তানে বাড়ীঘর ছেড়ে ( বেচতে পারলে বেচে নয়ত এমনি ছেড়ে দিয়ে) চলে গেল। অবশ্যি এই দাঙ্গা থামানোর জন্য গান্ধীর অনশন এবং পূর্ব বাংলা আর বিহারে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান অনেক উপকার দিয়েছিল। '৪৬ সালের আগস্টের দাঙ্গার এক বছর পরে '৪৭ সালের আগষ্টের ১৪-১৫ তারিখের মাঝ রাতে ভারতবর্ষকে ভারত আর পাকিস্তানে দুভাগ করে বৃটিশ গভর্ণমেন্ট এদেশ ছেড়ে চলে গেল। র্যা ডক্লিফ বাঁটোয়ারা এই ভাগেরনাম, কিন্তু গ্রামগঞ্জে কে কবে কোথায় থানার সীমানা মেনে তাদের জমি জায়গা করেছে। তাই কোথাও বাড়ী ভারতে আর তার ক্ষেত পাকিস্থানে পড়ল। যেহেতু স্থানীয় বাসিন্দাদের ধর্মের মেজরিটি ধরে এই ভাগ করা হয়েছিল তাই মুর্শিদাবাদ পাকিস্তানে আর যশোহর ভারতে আসার কথা, কিন্তু ম্যাপে লাইন টেনে ভাগ করা হলেও, হিসাবে ভুল হওয়াতে যশোহর গেল পাকিস্তানে আর মুর্শিদাবাদ ভারতে রইল। স্থানীয় লোকেরা এই ভুলটা বুঝতে পেরেছিল দু দিন বাদে।


১৪ই আগস্ট রাত ১১-৫৭ তে পাকিস্তান আর ১৫ই আগষ্ট রাত ০০-০২ মিনিটে ভারত তাদের নিজেদের আর পরাধীন বলে ভাবতে দরকার বোধ করলো না। বাবা স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে আমাদের সবাইকে ওই রাতে জাতীয় পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে শপথ নেওয়াল যেন আমরা কোন ভাবেই দেশের বিরুদ্ধে কোন কাজ না করি। অবশ্যি তখনও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের চরখা আঁকা তিন রঙা পতাকাই জাতীয় পতাকা বলে মানা হত। ভারতের সংবিধান তৈরী হবার পরে অশোক চক্র আঁকা তিরঙ্গা পতাকাকে আমাদের জাতীয় পতাকা বলে স্থির করা হল।
 

এই ভাবে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হওয়াতে রিফিউজিদের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া শুরু হল। আমার মনে হয় মানবজাতির সবচেয়ে করুণক্ষণ এই সময়ই ছিল। যুদ্ধে লোকে শত্রুর আক্রমণ থেকে বাচতে দেশ ত্যাগ করে, কিন্তু এবার পড়শিদের শত্রু হিসাবে দেখে লোকে দেশ ছাড়ল। তাদের স্থাবর সম্পত্তি সরকার এনিমি প্রপার্টি এক্টে দেখভাল করার দায়িত্ব নিল। অবশ্যি দেখভাল কতটুকূ হয়েছে তা সরকারই জানেন। আমি দেশ ছেড়ে অন্য দেশে চলে গেলে আমি কি করে দেশের শত্রু হই তা আমার ঠিক জানা নেই। এটা তখনি হতে পারে যদি যে দেশে গেছি তার সাথে যে দেশ থেকে গেছি তার যুদ্ধাবস্থা থাকে।
আগস্টের দাঙ্গার জন্য স্কুলের পরীক্ষা নামমাত্র ভাবে নেয়া হল কেননা কলকাতা থেকে লোকেরা তাদের গ্রামের দিকে চলে গিয়েছিল। মামু তখন কার্শিয়াং এ বাটা কোম্পানিতে কাজ করছেন। আমরা সবাই (তিন ভাই আর দুই বোন) মামুর কাছে চলে গেলাম। বাবা-মা ছোটবোন খুকুকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে এলেন। সেপ্টেম্বারের শেষ থেকে ডিসেম্বার পর্য্যন্ত আমরা কার্শিয়াং এ ছিলাম। সেই দিন গুলো ভোলার নয়।

 
মামুর বাড়ীটা ছিল সদর রাস্তা হিল কার্ট রোড আর ডাউ হিল (কার্শিয়াং এর সবচেয়ে উঁচু জায়গা) এর মাঝামাঝি। বাড়ীর জানলা দিয়ে ভোরবেলা কাঞ্চঞ্জঙ্ঘার উপর সূর্যদয় এর রঙের খেলা দেখতে প্রথম খুব ভাল লাগত কিন্তু রোজ তার জন্য ভোরবেলা লেপ ছেড়ে ওঠাটা মোটেই পছন্দ ছিল না। সময়টা ছিল শীতের সুরু যখন আমরা পৌঁছেছিলাম, আর ডিসেম্বারে বেশ ভাল ঠাণ্ডা পড়ে যায়। কিন্তু আমরা সোয়েটার আর হাফপ্যান্ট পরেই ঠান্ডা কাটিয়েছি। কোনদিন পাহাড়ের ঢাল ধরে নিচে বালাসন নদী পর্য্যন্ত আবার কোন দিন ডাউ হিলের উপরে স্যানাটরিয়াম পর্য্যন্ত ভাইরা ঘুরে আসতাম। আবার হিল কার্ট রোড ধরে গিদ্দাপাহাড় এর ঝর্ণা পর্য্যন্তও ঘুরে আসতাম। আর বৃষ্টি হলে পড়ে মামুর দোকানের ভেতরে বসে রাস্তার লোকেদের যাতায়াত দেখতাম। পড়ে '৫৫ সাল্র আবার যখন কার্শিয়াং গিয়েছি তখন শহরের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পাহাড়ের ধস নেমে আমাদের থাকার বাড়ীটা আর দেখতে পাইনি।


আমার স্কুল আর বাড়ীর মধ্যে বিদ্যাসাগর কলেজের স্টুডেন্ট হস্টেল পড়ত। হস্টেলে থাকা তিনজনের সাথে আমাদের খুব বন্ধুত্ব হয়েছিল। প্রথম ব্রজেন দাস। যিনি পড়ে ঢাকাতে চলে যান আর পাকিস্থানের নাগরিক হিসাবে ইংলিশ চ্যানেল সাঁতরে পাড় হন। ব্রজেনদার সাথে উনি ঢাকা চলে যাওয়ার পরে আর দেখা হয়নি। দ্বিতীয় ওনারই সহপাঠী দ্বিজেন মন্ডল। বসিরহাটের কাছে খোলাপোতা গ্রামের থেকে কলকাতায় পড়তে এসেছিলেন। দু তিনবার ওনার গ্রামের বাড়ীতে গিয়েছিলাম। ওনার মা ছিলেন না, মাতৃসমা বৌদি অনাকে নিজের ছেলের মতন করে মানুষ করেছিলেন। গ্রামে জাতের বিচার তখন এত বেশী ছিল যে সবার মাথা খারাপ হচ্ছিল এই ভেবে যে আমাদের খাবার কে বানাবে। ঊনি বললেন যদি দ্বিজেন আমার ছেলের মত হয় তবে ওরাও আমার ছেলের মত,তাই আমিই বানাব। আজকে আমি অবাক হই যে ওরকম মনের জোর উনি কি করে পেয়েছিলেন। এই দ্বিজেনদা পরে ডাক্তার হয়েছিলেন কিন্তু তার সাথে আর কোন যোগাযোগ হয়নি। তৃতীয় জামশেদপুর থেকে পড়তে আসা বুড়োদা। বক্সিং চ্যাম্পিয়ন। এর কাছে আমরা বক্সিং শিখতাম। সেই শেখার দাগ হিসাবে আমার নাকের হাড়টা এখনো ভাঙ্গা।


যথা নিয়মে ১৯৪৯ সালে কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিয়ে পাশ করলাম। মজা হল ১৪ বছর বয়স না হলে পরীক্ষাতে বস্তে পারা যাবে না। আমার বয়াস দেখা গেল ৪ মাসের মতন কম হচ্ছে। ফর্ম ফিল আপ করার সময় আমার সব চেয়ে প্রিয় মাস্টারমশাই সেটা বাড়িয়ে জন্মতারিখ বদলে পয়লা মার্চ করে ১৪ বছর করে দিলেন। পরীক্ষাতে পাশ করে কলেজে ভর্তি হলাম, কিন্তু তার কথা পরে কোন একদিন লিখবো। ছোট বেলার কথার এখানেই ইতি।।
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন